পিতৃত্ব

পিতৃত্ব
-প্রলয় কুমার নাথ

 

 

(১)

সেদিন সন্ধ্যা বেলা অফিস থেকে বাড়ি ফিরে, টিভিতে খবরের চ্যানেলটা খুলে সবে একটু বসেছি। আমার স্ত্রী, সুতপা কিছুক্ষণ আগেই এক কাপ চা আর মুড়ি মাখা রেখে গিয়েছে আমার সামনে টেবিলের ওপর। ঠিক সেই সময় স্কুল থেকে বাড়ি ফিরলো আমাদের আট বছরের একমাত্র ছেলে পিকন। নিতান্ত ছাপোষা চাকরি আমার একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে, মাইনেও সেরকম ভালো নয়। এই দুটো মাত্র ঘরের ভাড়া বাড়িতে, আমাদের তিনজনের ছোট্ট সংসারটাকে নিম্ন মধ্যবিত্তই বলা চলে। তবুও পিকনকে কলকাতার একটি নামী ইংলিশ-মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করিয়েছি, সেখানকার সমস্ত খরচ জুগিয়ে নিতান্ত সঙ্কুচিত হয়েই চলে আমাদের এই জীবনযাপন। তবুও স্বপ্ন দেখি, যে পিকন ভালো স্কুলে পড়ে একদিন অনেক বড় হবে, তখন আর আমাদের কোন অভাব অনটন থাকতে দেবে না সে। কিন্তু মাঝে মাঝে সেই স্বপ্নভঙ্গ হয় একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে……এমন স্বপ্ন তো আমার মা বাবাও দেখে থাকবেন আমাকে নিয়ে, কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হয়েছে কি?

এমন সময় পিকন স্কুলের ইউনিফর্ম ছেড়ে, হাত মুখ ধুয়েই, ছুটে এসে আমাকে বলে উঠল,
– জানো তো বাপি…..স্কুল ছুটির পর আজ যখন আমি বাসে উঠতে যাচ্ছি, তখন না একটা দাদু আমায় ডাকছিলো!
আমি আশ্চর্য হয়ে বলে উঠলাম,
– সে কি রে! তুই চিনিস সেই দাদুকে? কেন ডাকছিলো সে তোকে?
পিকন তার ছোট্ট মাথাটা দুদিকে ঘুরিয়ে বলে উঠল,
– না গো বাপি, আমি তাকে চিনি না……তবে সে আমাকে বার বার বলেছিলো, যে তোমার বাবাকে বলো তার নিজের বাড়ি যেতে……
আমি চমকে উঠে ওকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় সুতপা বেশ রাগী গলায় ওকে পেছন থেকে বলে উঠল,
– তোমাকে না বলেছি, রাস্তার কোন অচেনা লোকের সাথে কথা বলবে না……জানো না, রাস্তায় কত ছেলেধরা ঘুরে বেড়ায়……যাও পড়তে বসো, আর যেন কখনো না শুনি যে তুমি অচেনা কারোর সাথে কথা বলেছো!
পিকন বেজার মুখে চলে গেল ওর ঘরে……জানি না কেন, আমি আর খুব বেশি কথা বাড়ালাম না এই বিষয়ে।

আশ্চর্যজনক ভাবে, পরদিনও স্কুল থেকে ফিরে, আমার কানে ফিসফিস করে পিকন সেই এক কথা বলে গেল, যাতে সুতপা এই কথা শুনতে না পায়। আজও নাকি, স্কুল ছুটির পর রাস্তায় দাঁড়ানো বাসের কাছে আসতেই, পিকনের দেখা হয়েছে সেই অচেনা “দাদু”-র সাথে। তিনি আজও তাকে হাতছানি দিয়ে ডেকে সেই একই কথা বলেছেন, “তোমার বাবাকে বলো, তার নিজের বাড়ি যেতে”! মনে বেশ কৌতূহল জাগলো আমার…..কে এই ভদ্রলোক? আর কেনই বা তিনি আমাকে সেই স্থানে বার বার যেতে বলছেন, যা আমি দশ বছর আগেই সারাজীবনের জন্য ত্যাগ করে এসেছি? না, তিনি আর যেই হোন না কেন, আমার বাবা হতে পারেন না…..কিছুতেই না…….

(২)

এখনো চোখের সামনে, দশ বছর আগেকার সেই সমস্ত ঘটনার স্মৃতি জ্বলজ্বল করে ভেসে ওঠে…..যার জন্য আমি বাধ্য হয়েছিলাম বংশ মর্যাদার ঔদ্ধত্য আর অর্থের অহংকার দিয়ে গড়া সেই রাজপ্রাসাদ থেকে সকল বাঁধন ছিন্ন করে, এক কাপড়ে বেরিয়ে যেতে! সেদিন নাড়ির টান যেন বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো আমার মনের টানের রাস্তায়, আর বলা বাহুল্য, আমি বেছে নিয়েছিলাম দ্বিতীয়টাকেই! কলেজে পড়ার সময়ই আমার সুতপার সাথে প্রথম দেখা, আর তারপর থেকে যেন কোন মেয়ের দিকেই আর চেয়ে দেখিনি আমি। জানি না কেন, সেই নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের শ্যমবর্ণ মেয়েটিই যেন জুড়ে ছিলো আমার হৃদয়ের সর্বাংশে। এদিকে ধনী বনেদী পরিবারের একমাত্র সন্তান আমি, আমাদের বাড়ির কোন ছেলেকেই পারিবারিক ব্যবসা ছেড়ে চাকরির খোঁজ কখনো করতে হয়নি। আমি জানতাম, যে প্রথম দেখাতে, সুতপাকে বাড়ির পুত্রবধূ হিসাবে কখনোই মেনে নেবেন না আমার দাম্ভিক পিতৃদেব। তবুও আশা ছিল, যে সন্তানের মন একদিন বুঝতে পারবেন তার পিতা!

কিন্তু আচমকাই, একদিন সেই আশাতেও জল ঢেলে দিলেন আমার পিতৃদেব। হঠাৎ করেই একদিন তিনি আমায় জানালেন, যে তিনি আমার বিবাহ স্থির করেছেন, তার বিজনেস পার্টনার, দিলীপ বাবুর মেয়ে পাপিয়ার সাথে। দিলীপ কাকুর পরিবারের সাথে আমাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক অনেক দিনের, এই কথা আমি জানি……শুধু জানতাম না, আমাকে ব্যবহার করে, বাবার সেই সম্পর্ককে দীর্ঘজীবী করার সেই অভিসন্ধির কথা। সেদিন সুতপাকে সেই বাড়িতে নিয়ে এসে, স্পষ্ট ভাষায় বাবার চোখে চোখ রেখে জানিয়ে দিয়েছিলাম আমি,
– পাপিয়াকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়…..কিছুতেই নয়…..কারণটা তুমি খুব ভালো করেই জানো, আমি সুতপাকে……
মা হয়তো আমাকে সমর্থন করেই কিছু বলতে চলেছিলেন, তিনি বাবার রক্তচক্ষু দেখে থেমে গেলেন তিনি। আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই, বাবা গর্জে উঠেছিলেন,
– তাহলে ওই ছোটলোকের মেয়েটার সাথেই সংসার পেতে ফেলো তুমি……তবে তা এই বাড়ির চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে!
সকলের প্রকাশ্যে এমন অপমানিত হয়ে, সুতপা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে, ছুটে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়েছিল সেই বাড়ি থেকে, আমি ছুটে গিয়ে তার হাত ধরে তাকে থামিয়েছিলাম। তারপর বাবার জ্বলন্ত চোখের সামনে, ওকে জড়িয়ে ধরে, ওর ঠোঁটে ঠোঁট রেখে বলেছিলাম আমি,
– শুধু তোমার জন্য….শুধু তোমার জন্য আমি এই বংশ গৌরব, ধন, দৌলত, ঐশ্বর্য…..এই সব কিছু আমি ছাড়তে রাজি…..এখন শুধু তোমার মতামত দরকার, সুতপা……বাপের কাছ থেকে ত্যাজ্যপুত্র হওয়া একটি মানুষের সাথে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ-এর উদ্যেশ্যে পাড়ি দিতে, তুমি রাজি হবে তো?
সুতপা কোন উত্তর দেয়নি সেদিন, শুধু আমার বুকে থাকা জামার অংশটা ভিজিয়ে দিয়েছিলো নিজের চোখের জলে……আমি পেয়ে গিয়েছিলাম আমার প্রশ্নের উত্তর!

সেদিনই ছিল আমার সেই বাড়িতে শেষ দিন। মায়ের শত অনুরোধ উপেক্ষা করেও, আমি সুতপার হাত ধরে বেরিয়ে পড়েছিলাম সেই নিরাপদ আশ্রয়ের বাইরে। বাড়ির সদর দরজার বাইরে পা ফেলতে ফেলতেও শুনেছিলাম, মার কান্নার আওয়াজের সাথে, বাপের তীব্র ভৎসনা,
– যা….যা…..বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে…..আজ থেকে আমি জানবো, যে আমার কোন ছেলে নেই…..আমার সমস্ত সম্পত্তি আমি কোন অনাথ আশ্রমকে দান করে দেবো…..বাড়িয়ে যা তুই, বেরিয়ে যা……..
তারপর থেকে আর কোন সম্পর্ক নেই আমার বাপ-মায়ের সাথে। এই দশ বছর ধরে আমাদের ফোনে লাগানো অন্য সিম কার্ড, যাতে তারা আর কোনো ভাবেই কথা বলতে না পারেন আমাদের সাথে। আমাদের ভাড়া বাড়ির ঠিকানাও তাদের অজানা। অবশ্য, এতদিন পরেও তাদের কাছ থেকে নিজেদের এতটা দূরত্বে রাখার পরামর্শটা কিন্তু সুতপার……তার কানে যেন এখনো বাজে, তার উদ্দেশ্যে বাবার বলা সেই কথাটা, “ছোটলোকের মেয়ে”!

(৩)

তাই পিকনের কথা শুনে, আমার মনের কৌতূহল যেন বেড়েই চলেছিল। পরদিন অনেক কষ্টে অফিসের বসকে রাজি করিয়ে, একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়ে পড়েছিলাম আমি। ছুটে গিয়েছিলাম ছেলের স্কুলের গেটের বাইরে। নির্দিষ্ট সময়ে স্কুল ছুটি হওয়ার পর, একে একে স্কুলের গেট থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলো কচি কাঁচাদের দল। তাদের মধ্যে পিকনও স্কুলের গেট থেকে বেরিয়ে এসেছিল, কিন্তু তারপর আমাকে দেখে একটু থমকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল,
– বাপি তুমি!…..ও বুঝেছি, তাহলে আজ তুমি আমাকে স্কুল থেকে বাড়ি নিয়ে যেতে এসেছো, তাই না বাপি?
ওর কথার উত্তর দেওয়ার আগেই, পেছন থেকে ভেসে এল সেই পরিচিত গলার গুরুগম্ভীর ডাক,
– খোকা!
আমি চমকে উঠে, পেছন ফিরে চেয়ে দেখলাম এক বয়সের ভারে ভেঙে পড়া বিদ্ধস্ত মানুষকে…….আমার সকল বিশ্বাসকে চূর্ণ করে মুর্তিমানের মত আমার সামনে যে আজ দাঁড়িয়ে আছে, সে আর কেউ নয়…..আমার বাবা! তার মানে তিনিই রোজ পিকনকে বলেছেন আমাকে বাড়ি ফিরে আসার কথা বলতে…..কিন্তু তিনি জানলেন কি করে, যে পিকন এই স্কুলে পড়ে! সেই মুহূর্তে আমি পিকনের উদ্যেশ্যে বললাম,
– না, আমি তোকে নিতে আসিনি রে, যা….যা তুই বাসে উঠে যা…..আমার অন্য কাজ আছে ……

অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা স্কুল বাসে পিকন উঠে গেলে, আমি বাপের দিকে ঘুরে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই তিনি বলে উঠলেন,
– বাড়ি ফিরে চল, খোকা……আমার জন্য না হলেও, তোর মায়ের জন্য…..সে যে আজও বড্ড কান্নাকাটি করে তোদের জন্য……এই বয়সে তোদের ছাড়া আমাদের দেখার আর কে আছে, বল……
আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম যে, বিকালের পড়ন্ত রোদে বাবার চোখের কোনায় জল চিকচিক করছে, তার সেই দাম্ভিক কণ্ঠস্বরে আজ বিনয়ের সুর! তার মানে কি বয়সের ভারে বিগলিত হতে শুরু করেছে তার পাথর সম হৃদয়!
নিজের অজান্তেই, আমার কন্ঠ থেকে কে যেন বলে উঠেছিল,
– আমি তো ফিরে আসতেই চাই, বাবা…..ফিরে আসতে চাই আমি…..কিন্তু সুতপা! তার মনে যে তোমার প্রতি ঘৃণা এই দশ বছরেও এতটুকু কমেনি, বাবা!
চশমা খুলে নিজের দুচোখ মুছে, তিনি উৎসাহের গলায় বলে উঠেছিলেন,
– তুই শুধু বৌমাকে একবার বাড়ি নিয়ে আয় খোকা……আমি আর তোর মা মিলে তাকে বোঝাবো খন……গুরুজন হয়ে না হয় দুটো কড়া কথা বলেই ফেলেছি তাকে, তাই নিয়ে কি এতবছর রাগ করে থাকলে চলে? আর….আর সে যদি নিতান্তই না মানে…..তাহলে…..তাহলে তার পা ধরে ক্ষমা……….
বাবার কথা শেষ না হতেই, আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম,
– ছি ছি, বাবা…….এ কি বলছো তুমি! এসব বললে যে আমাদের অমঙ্গল হবে!
বাবা যেন এবার অধৈর্য হয়ে বলে উঠলেন,
– তাহলে তুই বল….আমায় কথা দে….আমায় কথা দে, খোকা…..যে তুই বাড়ি ফিরে আসবি…..আমার কাছে কিন্তু বেশি সময় নেই…..আমায় কথা দে, খোকা!
আমি নিজের অজান্তেই আবার বলে উঠলাম,
– কথা দিলাম……কথা দিলাম যে কালই আমরা ও বাড়ি ফিরে যাবো, বাবা….. কথা দিলাম!
সেই মুহূর্তেই তিনি হনহন করে চলে গেলেন সেই রাস্তা থেকে, আমাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করার সময়টা অবধি দিলেন না তিনি! তখনই দেখলাম, যে পিকনদের স্কুল বাসটাও স্টার্ট দিলো ছাত্র ছাত্রীদের বাড়ি ফেরানোর উদ্দেশ্যে। দেখলাম, যে পিকনও বাসের একটি জানলার পাশে বসে, ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে আমাদেরই দিকে!

(৪)

সেদিন রাত্রি বেলা, সুতপার দুহাত চেপে ধরে, আমি তাকে এক নিঃশ্বাসে বলেছিলাম সমস্ত কথা। বলেছিলাম, যে এই নিয়ে তিনদিন ধরে বাবাই রোজ এসেছেন পিকনের স্কুলের কাছে, আমাদের ও বাড়িতে ফিরে যাওয়ার কথা বলতে। বলেছিলাম, যে আমি বাবাকে কথা দিয়েছি, যে তোমাকে রাজি করিয়ে কালই ও বাড়িতে ফিরে যাবো! সব শুনে কিছুক্ষন গম্ভীর হয়ে বসেছিল সুতপা। তারপর হঠাৎ মুচকি হেসে আমাকে বলেছিল,
– আমি শুধু এই দিনটারই অপেক্ষায় ছিলাম, তনয়…..যেদিন তোমার বাবা নিজে থেকে আমাদের কাছে এসে নিজের ভুল স্বীকার করবেন……মা বাবা তো আমারও আছে……নাহ, আমি আর তোমাদের বাপ-ছেলের সম্পর্কের মধ্যে কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে চাই না…….তাহলে, কালই আমরা যাচ্ছি তো ও বাড়িতে?
ওর কথা শুনে একটা মস্ত বড় পাথর যেন সরে গিয়েছিল আমার বুকের ওপর থেকে!

পরদিন সকালেই সুতপা আর পিকনকে নিয়ে ছুটে গিয়েছিলাম সেই দশ বছর আগে ফেলে আসা পথ ধরে। সেই কোন কালে ফেলে আসা ওলি গলি, নিজের ঘরের বিছানা, মায়ের হাতের রান্না, পাড়ার রকে বসে বন্ধুদের ঠেক, বাবার সেই ব্যক্তিত্বে ভরা মুখশ্রী……এই সবকিছু যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছিল আমায়! উত্তর কলকাতার সুবৃহৎ দোতলা বাড়িটা যতই দূর থেকে ভেসে আসছিল চোখের সামনে, ততই যেন বুকের ভেতর বেজে উঠছিল পূনর্মিলনের খুশির সুর! কাছে যেতে বুঝতে পারলাম, যে এই দশ বছরে বাড়িটার চেহারার যেন যথেষ্টই অবনতি হয়েছে। জায়গায় জায়গায় আগাছা আর দাঁত বার করা ইঁটের সারি স্পষ্টই প্রমাণ করছে মেরামতির ঘোর অভাব। তবে সেদিকে খুব একটা ভ্রুক্ষেপ না করে, আমি খুশির আমেজে মশগুল হয়ে, সুতপা আর পিকনকে নিয়ে সোজা ঢুকে পড়লাম বাড়ির খোলা সদর দরজা দিয়ে……..

(৫)

কিন্তু বাড়ির ভেতর ঢুকেই, মনে হল চারিদিকের আবহাওয়া কেমন যেন থমথমে! বাড়ির নিচতলার বসার ঘর থেকে ভেসে আসছে বেশ কিছু মানুষের গলার আওয়াজ……আমি আশ্চর্য হয়ে বাবা মাকে ডাকতে ডাকতে, ওদের দুজনকে নিয়ে ছুটে গেলাম সেদিক পানে। কিন্তু সেই ঘরের মধ্যে ঢুকেই আমাদের তিনজনের চক্ষুস্থির হয়ে গেল! ঘরের ভেতর ভর্তি আত্মীয় স্বজন আর পাড়া প্রতিবেশীদের ভিড়……তাদের সকলের মাঝে রাখা রয়েছে, রজনীগন্ধার মালা জড়ানো বাবার একটি মাঝবয়সের ছবি! সেই ঘরের এক কোনে বিধবার বেশে হতভম্ব হয়ে বসে থাকা মাকেও দেখতে পেলাম এতক্ষণ পর! আমাকে দেখতে পেয়ে তিনি যেন ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন, তারপর ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বুক ফাটা কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি,
– এত বছর …..এত বছর পর, এখন আসার সময় হল তোদের…..এখন আসার সময় হল তোদের, খোকা! মানুষটা…..মানুষটা যে আমাদের সকলকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল রে, খোকা…….. চলে গেল…….
বিস্ময়ে আমার গলা দিয়ে যেন কথা বেরোল না আর, আমি পাথরের মূর্তির মত স্তব্ধ হয়ে শুনতে লাগলাম, যে মা উন্মাদের মত কেঁদেই চলেছেন,
– সারাটা জীবন…..সারাটা জীবন মানুষটা তোদের জন্যই অপেক্ষা করে গেল রে, খোকা…..…বলতো, যে দেখো একদিন না একদিন ঠিক খোকা বৌমাকে নিয়ে ফিরে আসবে এই বাড়িতে…….তুই তো জানিসই তোর বাবা কি ধাতে গড়া……ভাঙবে কিন্তু মোচকাবে না…….তাই মন থেকে তোদের ফিরে পেতে চাইলেও, কখনো আগ বাড়িয়ে তোদের খোঁজ খবর নিতে চাইনি সে……..তুই কি একটুও চিনলি না তাকে, খোকা……এই তোর আসার সময় হল……

বাড়িতে উপস্থিত সমস্ত অতিথিরা যেন হতবাক হয়ে চেয়ে রয়েছেন আমাদের দিকে। কারোর মুখে কোন কথা নেই, এমন সময় অনতিদূর থেকে দিলীপ কাকু উঠে এলেন আমাদের কাছে। তারপর তিনি একটা দীর্ঘনিঃস্বাস ফেলে বলে উঠলেন,
– তোমার মা সত্যি কথা বলছেন, তনয়……পুরো এক সপ্তাহ ধরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তোমার বাবা, গতকাল বিকালেই মারা যান তিনি…….তবে মৃত্যুর আগে অবধি তার শুধু একটাই ইচ্ছা ছিল, যে তোমরা যেন নিজে থেকেই ফিরে আসো এই বাড়িতে, আর সেই জন্যই তিনি কিছুদিন আগে উইল করে সমস্ত সম্পত্তি তোমার নামেই লিখে দিয়ে গেছেন…….কিন্তু তার সেই শেষ ইচ্ছা আর পূরণ হলো কই!
আমি সম্পত্তির কথায় কর্ণপাত অবধি না করে, অস্ফুট স্বরে শুধু একটা কথাই বলে উঠলাম,
– কি বললেন আপনি! এক সপ্তাহ ধরে বাবা হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন! গতকাল বিকালেই তিনি মারা গিয়েছেন!……তাহলে…..তাহলে…..গত তিনদিন ধরে পিকনকে স্কুলের কাছে……..

আমার কথা শেষ না হতেই, স্বয়ং পিকনই বলে উঠল,
– ওফ ও বাপি……ওই দুদিন তো এই দাদুই আমার সাথে দেখা করে তোমাকে বাড়ি ফিরে আসার কথা বলতে বলেছিলো……
এই বলে সে দিলীপ কাকুর দিকে নিজের হাতের ছোট্ট আঙ্গুলটা দিয়ে ইঙ্গিত করল। এই কথা শুনে ম্লান হেসে দিলীপ কাকু বলে উঠলেন,
– তোমার ছেলে ঠিকই বলছে, তনয়…….ও যে স্কুলে পড়ে, তার খুব কাছেই আমার জামাই (মানে পাপিয়ার স্বামী) ফ্ল্যাট কিনেছে…..পাপিয়া আমাকে বলেছিল, যে স্কুল বাস ছাড়াও, ও মাঝে মাঝে ফ্ল্যাটের ব্যালকনি থেকে তোমাকেই দেখেছে পিকনকে স্কুল থেকে নিয়ে আসতে……তুমি হয়তো তাকে লক্ষ্য করনি……..এদিকে তোমার বাবার এই অবস্থা, আর তোমার কোন খোঁজ খবরও নেই, তাই আমি দুদিনের জন্য গিয়েছিলাম মেয়ের ওখানে……যদি তোমার সাথে একবারটি দেখা হয়ে যায়, কিন্ত তা আর হল না। তাই পাপিয়ার কথামত, স্কুল ছুটির সময় আমিই পিকনকে বলতাম তোমাকে বাড়ি ফিরে আসার কথা বলতে……এছাড়াও তোমার খোঁজ খবর, ঠিকানা আর মোবাইল নাম্বারও চেয়েছিলাম ওর কাছ থেকে, কিন্তু ও বাচ্চা ছেলে…..সে সব তো আমাকে বলতে পারলই না……বরং আমার কাছে আসতেই ভয় পেত ও, হয়তো ভাবতো আমি কোন ছেলে ধরা! তোমার বাবার যাই যাই অবস্থা শুনে, গতকাল সকালেই ফিরে এলাম এখানে! আর কাল বিকালেই…….

আমি এবার পাগলের মত পিকনের দুই কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে বলে উঠলাম,
– আর তৃতীয় দিন……মানে গতকাল বিকালে…..সেদিন…..সেদিন যে আর এক দাদু আমাদের সাথে দেখা করে গেল, পিকন! তোর স্কুলের সামনেই! তুইও তো তখন ওখানেই ছিলিস…..বাসের জানলা থেকে তাকে নিশ্চয় দেখেছিলিস তুই…..বল, বল……আমার কথার জবাব দে……এ কি করে সম্ভব! কি করে…….
আমার কথা শেষ না হতেই, পিকন বেশ কুণ্ঠার সাথে বলে উঠল,
– সেদিন তো কোন দাদুই আমাদের সাথে দেখা করতে আসেনি, বাপি…..কেউ না, কাউকেই দেখিনি আমি……শুধু….শুধু বাসের জানলা থেকে তোমাকেই দেখেছিলাম নিজের মনে কথা বলতে……শুধু আমি নই, আমার ফ্রেন্ডরাও তোমাকে ওই ভাবে নিজে নিজে কথা বলতে দেখেছিলো……সবাই হেসে বলছিল “ইওর ড্যাড ইস ম্যাড”……আমি তোমাদের বকা খাওয়ার ভয়ে বাড়িতে এসে কাউকেই এই কথা বলিনি, বাপি!
আমি আতঙ্কে আরোষ্ঠ হয়ে ঘরের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম বাবার মালা পড়ানো ছবিটার দিকে চেয়ে……এখনো যেন সেই ছবির ভেতর থেকে কানে ভেসে আসছে তার কণ্ঠস্বর,
– তাহলে তুই বল….আমায় কথা দে….আমায় কথা দে, খোকা…..যে তুই বাড়ি ফিরে আসবি…..আমার কাছে কিন্তু বেশি সময় নেই…..আমায় কথা দে, খোকা!

Loading

One thought on “পিতৃত্ব

Leave A Comment